মাসুদ
বয়ানদাতার নামঃ মোঃ মোতালেব (বাবা), রেজিয়া খাতুন (মা), মনোয়ারা বেগম (বোন), মামুন (ভাই)
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে ২য় ছিল মাসুদ। মোতালেব অন্যের জমি আবাদ করতেন, মাসুদ পড়াশুনা করতো। টানাটানির সংসারে ৯ম শ্রেনী পাশ করার পর আর লেখাপড়া করা হয়নি। ২০০৮ সালে প্রতিবেশী ফয়দুলের সহায়তায় সে ঢাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ নেয়, দুই বছর পর তাজরীন গার্মেন্টসে যোগদান করে। মৃত্যুর মাসখানিক আগে ৬৩০০ টাকার বেতনে সিনিয়র অপারেটর হিসাবে পদন্নোতি হয়। ফ্যাক্টরীর পিছনদিকে মসজিদের কাছে তাজরীনের আরো ৪ জন শ্রমিকের সাথে মাসুদ থাকতেন, ঘটনার দিন মাসুদ ছাড়া অন্য ৪ জনের বিকালে কাজের সিফট ছিল না।
যেকোন উপায়ে অনেক অর্থ আয় করে মাসুদ সংসারের অভাব ঘুচাতে চেয়েছিল। একবার মোতালেবের কাছে এসে বলে, ”বাবা, আমি টাকা বানাবো। আমার সাথে একজন লোক আছে, তার কাছে টাকা বানানোর মেশিন আছে। আমি তার সাথে থেকে টাকা বানাবো।” মোতালেব এসব না করার জন্য ছেলেকে বারন করেছিল। কয়েকদিন পর গ্রামে এসে মাসুদ বাবার কাছে ২০০০ টাকা চেয়েছিল, বাবা দিতে পারেনি। বাসায় একটা পুরনো সাইকেল ছিল, একদিন দেখে মাসুদ সেটা বিক্রি করে দিয়েছে। মারা যাওয়ার এক মাস আগে ঈদের ছুটিতে বাসায় এসে বাবাকে বলেছিল, ”এতদিন তোমাদের ঠিকমত টাকা পাঠাতে পারিনা, এখন সিনিয়র অপারেটর হয়েছি, বেতন বেড়েছে, এবার মাসে মাসে বেশী করে টাকা পাঠাতে পারবো।” সেটাই ছিল তার পরিবারের সাথে শেষ দেখা। মাসুদ তার নবজাতক ভাগ্নের নাম ”আপন” রাখতে বড়ভাবীকে অনুরোধ করেছিল। কথা দিয়েছিল ছুটিতে এসে সবার প্রথমে ভাগ্নেকে দেখবে। বড় ভাই, মামুন পরে নিশ্চিন্তপুরের বাসায় বাবুর জন্য কেনা নতুন জামাকাপড় গোছানো অবস্থায় পেয়েছিল।
ফয়িদুল আগুন লাগার পরেরদিন ভোরবেলায় মোতালেবকে ফোনে অগ্নিকান্ডের কথা জানায়। ফ্যাক্টরীর ভিতর থেকে মাসুদ ফয়িদুলকে ফোন দিয়েছিল, ”ভাইরে আমারে বাঁচানোর চেষ্টা কর, আমি যে আর বাঁচি না।”
নীচের গেটগুলোতে তালা মারা। বিল্ডিং থেকে বের হওয়ার উপায় নাই।
ফয়দুল বলে, ”তুই শুধু উপরি ওঠ, খালি উপরি ওঠ।”
”উপরে যে উঠমু, ধোঁমায়তো কিছুই চোখে দেহি না”
এরপর থেকে ফোন বন্ধ, আর মোতালেবের ’পোলা’ কহে নাই’। ফয়দুলের ফোন পেয়ে বাবা তৎক্ষণাত কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। মাসুদের সন্ধানে বড় ছেলে মামুন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মাসুদের দুই খালা, আনোয়ারা ও রেহানা, সেসময় ঢাকায় অন্য গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করতো। দুই খালাকে সাথে নিয়ে মামুন এদিক-ওদিক খোঁজ করতে থাকে, শেষমেষ নিশিন্তপুর স্কুল মাঠে সারি সারি লাশের মধ্যে তারা মাসুদের নিথর শরীর খুঁজে পাই।
সাইদুলের শরীরে কোথাও পোড়ার দাগ ছিল না, শুধু মাথার কিছুর চুল পুড়ে গিয়েছিল। মা রেজিয়া যখন নিজ হাতে ছেলেকে গোসল করাচ্ছে, তখনও ফ্যাক্টরীর কেচিগেটের এক টুকরা লোহা মাসুদের হাতের মুঠোয় ভীষন শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছিল। শেষমুর্হূত পর্যন্ত তালাবদ্ধ গেট ভেঙ্গে মাসুদ বাচাঁর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। এই ঘটনার পর থেকে মাসুদের মা শ্রবনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, এখনো অপ্রকৃতস্ত আচরন করে। পরিবারের রীতি অনুযায়ী, মৃতব্যক্তির কোন কিছু সংরক্ষন করা হয়না, কিন্তু মা সেই লোহার টুকরাটা গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে এটা বের করে দেখে, তখন উদ্ভান্তের মত আচরন করে।
পরিবার মনে করে, মালিকপক্ষ ইচ্ছা করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের হত্যা করেছে, তা না হইলে অগ্নিকান্ডের সময় গেটে তালা কেন দিয়ে রাখবে! পরিবারের মানুষজন ঢাকায় যেয়ে ফ্যাক্টরীর আশেপাশের মানুষজনের কাছে শুনেছে, অগ্নিকান্ডের আগে মালিকপক্ষের লোকজন বলেছে, ’ফ্যাক্টরীর অনেক টাকা লোন হয়ে আছে, শ্রমিকের বেতন ঠিকমত দিতে পাচ্ছে না, তাই কবুতরের খুবরির মত ঘরে শ্রমিকদের আটকে রেখে পুড়িয়ে মারবে।’ পরিবারের লোকজন এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের বিচার চাই। মোতালেব ক্ষতিপূরনের টাকা দিয়ে জমি ও চাল-আটা ভাঙ্গার মিল কিনছে, ১ লক্ষ টাকা নাতিকে দিয়েছে আর মেয়ের বিয়েতে ৪ লক্ষ খরচ করেছে।