নূরজাহান

বয়ানদাতার নামঃ হুরমুজ আলী (বাবা), পাগলী বেগম (মা), নাহিদ (ছেলে), হারুন (ভাই)

হরমুজ আলী পাগলী বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে নূরজাহান ছিল ২য়। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না, দুই বেলা খেয়ে না খেয়ে সংসার চলতো। হরমুজ ইট ভাঙ্গার কাজ করতো। মধ্যকর্না প্রাইমারী স্কুলে ৫ম শ্রেনি পর্যন্ত পড়ার পর টাকার অভাবে নূরজাহানের আর পড়াশুনা করা হয়নি। ১০-১১ বছরে বিয়ে হয়ে যায়, কিন্তু স্বামীর সংসার বেশীদিন করতে পারেনি। বিয়ের দুই বছরের মাথায় স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে এক বছরের শিশুকে নিয়ে বাপের বাড়ী চলে আসে। অভাবের সংসারে সে ঘাটাইলের এক বেসরকারী ক্লিনিকে কাজ নেয়। কিন্তু এতো অল্প বেতন ছিল যে ছেলের জন্য দুধ কেনার টাকাও থাকতো না। প্রতিবেশী শাহীন মামা গার্মেন্টসে কাজ করতো, তার সাহায্য নিয়ে সে ঢাকার চলে আসে। তাজরীনে বছরের মত কাজ করেছিল। একবার মেয়েকে ঢাকায় দেখতে যেয়ে মা পাগলী বেগমও তাজরীনে কাজে ঢুকে পড়ে, কিন্তু দুইমাস কাজ করার পর নূরজাহান মাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে বলেতোমার এই কাজ করতে হবে না, তুমি দেশে যাও, আমি তোমাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাবো।

ফ্যাক্টরীর পিছন দিকে বাশঁঝাড়ের কাছের এক বাড়ীতে নূরজাহান থাকতো। ২৪শে নভেম্বর সন্ধ্যায় কেন জানি মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য পাগলী বেগমের মন আনচান করছিল। নূরজাহানের মোবাইলে ফোন দেওয়ার জন্য মা হুরমুজ আলীকে জোরাজোরি করতে থাকে। তারা তখনও জানে না, তাজরিনে আগুন ধরেছে। ক্লিনিকে কাজ করে মেয়ে বাবাকে এই মোবাইলটা কিনে দিয়েছিল। মাটির চুলার ধারে বসে হুরমুজ মেয়েকে ফোন দেই। মোবাইল ধরে নূরজাহান শুধু শুধুআব্বা, আব্বাবলে ডাকতে থাকে, আর কিছু বলে না, মোবাইলের ভিতর অনেকের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। শেষ কথা ছিল, ”আব্বা , আমি পরে ফোন দেই”, এরপর আর কখনো নূরজাহানের গলা শোনা যায়নি, কিন্তু মোবাইল খোলা ছিল, অনেক মানুষের হট্টগোলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। একটু পর মোবাইলের লাইনও কেটে যায়।  হুরমুজ তখনও হতভম্ব হয়ে চুলার পাশেই বসে আসে, এমনসময় সৌদি আরব থেকে নূরজাহানের খালাতো ভাই ফোন দিয়ে জানায়খালু, তাড়াতাড়ি ঢাকা যান, ঢাকার গার্মেন্টসে অনেক দূর্ঘটনা। তাড়াতাড়ি যান, নূরজাহানকে পান কিনা সন্দেহ আছে।নূরজাহানের মোবাইল থেকে কেউ একজন ফোন করে খালাতো ভাইকে এই কথা জানিয়েছে। নূরজাহানের মোবাইলের ডায়ালে প্রথম নম্বরটা তার ছিল, কারন সেও নূরজাহানকে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু কেউ সেই কল ধরে নাই।

হুরমুজের কাছে কোন টাকা ছিল না, আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে ৩০০ টাকা ধার করে বড় ছেলে, হারুন সহ বেরিয়ে পড়ে। অতো রাতে গাড়ী পাওয়া যাচ্ছিল না, যে গাড়ীগুলো ঢাকার দিকে যাচ্ছিল তারা অনেক বেশী ভাড়া চাওয়ায়, শেষপর্যন্ত ট্রাকে করে ঢাকার জামগড়ে পৌঁছাল। একজন জানালো, মা শিশু হাসপাতালে অনেকগুলো মৃতদেহ আনা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো এখান থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা জানে না। হুরমুজ ফ্যাক্টরী ঘুরে নূরজাহানের বাসায় গেলো, ওখানে সুমাইয়া থাকতো। সুমাইয়া নূরজাহানের খুব ভালো বন্ধু ছিল। সেদিন সুমাইয়া ডিউটিতে যায় নাই। হুরমুজ সারারাত পরেরদিন সারাদিন খুঁেজও মেয়ের কোন হদিস পেলো না। পরে সন্ধ্যার দিকে আশুলিয়া থানার ওসির কথামতো ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে গেলো, সেখানকার মর্গে রাখা ৭টি লাশের মধ্যে একজন ছিল নূরজাহান। লাশ হস্তান্তরের আশায় হরমুজ মর্গের বাইরে টিনশেডের ঘরের নীচে অপেক্ষা করছিল, এমনসময় একজন মৃতদেহ গ্রামে নেয়ার জন্য ৫০০০ টাকা চাইলো। মর্গের একজন কর্মী লাশ কাটা-ছেড়া করা বাবদ ১০০০০ টাকা দাবী করলো। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ২০০০০ টাকা নিয়ে হরমুজ ঐদিনই গ্রামের দিকে রওয়ানা দেয়। সন্ধ্যায় গ্রামে ফেরার পর এলাকার অনেক মানুষ লাশ দেখতে আসেনি, পুড়ে মারা গেছে শুনে তারা ভয় পেয়েছিল।

কিন্তু নূরজাহানের শরীরে পোড়ার চিহ্ন ছিল না। কফিনে রাখা নূরজাহানের মাথায় হাত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাত কালচে রক্তে ভরে যায়। দাফনের আগে মেয়েকে গোসলের সময় মা দেখেছে মেয়ের মাথার মাঝখানে তখনও ছোপ ছোপ অনেক রক্ত। ওর অনেক লম্বা চুল ছিল, রক্তে চুল জট পাকিয়ে গিয়েছিল। বছরের ছেলে নাহিদ শুনছে মা মারা গেছে, তখনও জানে নামারা যাওয়ারঅর্থ কি। ভীরের মধ্যে থেকে মৃত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নাহিদ ভয় পেয়ে যায়, ছুটে বেরিয়ে আসে, ঘরের ভিতর এসে শুয়ে পড়ে। মায়ের মুখে মাটিও দিতে পারে নাই। নূরজাহান ৪তলায় কাজ করতো, নীচে আগুন দেখে হয়তো দৌঁড়ে ৫তলায় উঠছিল, সেখানে ধাক্কাধাক্কিতে জানালা ভেঙ্গে নীচে পড়ে যায়। ফ্যাক্টরির এর পিছন দিকে নতুন বাড়ীর কাজ চলছিল, রড বের হয়েছিল। দেয়ালের উপর পরে মাথা থেতলে গেছে, গলার ভিতর দিয়ে চোখ বরাবর রড ঢুকে যাওয়ায় একটা চোখ বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। এসব তারা সুমাইয়ার কাছ থেকে পরে শুনেছে। নূরজাহানকে বের করার জন্য সুমাইয়া সেদিন ফ্যাক্টরীর আশেপাশে পাগলের মত ছোটাছুটি করেছে আর হুমরুজের ভাষায়চিগিরপারছে। এতো চিগির পারছে যে সুমাইয়ার নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল। অগ্নিকান্ড ঘটার সপ্তাহখানেক আগে নূরজহান বাড়ী এসেছিল। তখন বলেছিল, ”গার্মেন্টসে আর কাজ করতে ভালো লাগে না, আগামী শনিবার জিনিসপত্র নিয়ে একেবারে চলে আসবাম..” সেই শনিবারই গ্রামে ফিরলো, তবে লাশ হয়ে.. নূরজাহানের কথা ভেবে বাবা-মা আজও চিৎকার করে উঠে, চোখের জ্বলে বালিশ ভিজে যায়। ক্ষতিপূরনের টাকা দিয়ে হরমুজ আলী জমি কিনে বর্তমানের বাড়ীটা তৈরী করেছে। মা পাগলী বেগম মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে, গোলাপী রঙের সালোয়ার-কামিয-ওরনা পড়ে নূরজাহান এসছে, বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁেদ কেঁেদ বলতেছেবাবা, বাবা আমি পিঠের মধ্যে ব্যথা পাইছি, ভালাগতিসি না।

2022 © All Rights Reserved | Designed and Developed by decodelab