সাথী

বয়ানদাতার নামঃ মোকলেস সিকদার (বাবা), সখিনা (মা), সিয়াম (ভাই)

সাথীর জন্ম ১৯৮৮ সালে, এক ভাই, বোনের মধ্যে সবার বড়। সাথীর পরিবার টাঙ্গাইলের নামা এলাকায় থাকতো, এখানে বছরের প্রায় ছয় মাস পানি জমে থাকে বলে বেশী ফসল আবাদ হতো না, মানুষ জমিজামা বিক্রি করে সংসার চালাতো। মোকলেসদের নিজস্ব জমিও ছিল না, অন্যের জমি চাষ করতো, এদিক-ওদিক মাছ ধরতো, মাঝে মাঝে দুইবেলা খাবারের সংস্থানও হতো না। উপায় না দেখে ২০০৫ নাগাদ সাথীকে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে পাঠায়, কিন্তু সাথীর মন টিকতো না, কান্নাকাটি করতো, বারবার ঢাকা থেকে ফিরে আসতো। এরপর এক চাচাতো বোন, সেলিমার সাথে সাথীকে ঢাকায় পাঠানো হলো, ’হেবারটিকে গেলো। সাথীর মামাতো বোন সোমা তাজরীন গার্মেন্টসে কাজ করতো, তার মাধ্যমে তাজরীনে কাজ নেয়, তারা একসাথেই থাকতো। প্রতি মাসে বাসায় ৫০০০ টাকা পাঠাতো। এই টাকা দিয়ে মোকলেস ঘর তুলছে। মায়ের সাথে তেমন গল্প করতো না, কিন্তু সংসার নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। সাথীর জিদআছিলসংসারে আরোজিনিসপাতিকরবো।

সাথী প্রায় বছর তাজরীনে কাজ করেছে। কুরবানী ঈদের পর বাবা-মা-ভাই ঢাকায় যায়। সাথীর শরীর একদম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ওরা সাথীকে বলে, ”তোর চাকরীর দরকার নয়কা, চল যায়গা। জীবনের চে কয়লাম কচু হাট বেশী না, চাকরী করন যাইবো, বাইচ্যা থাকলা, যাইগা।

ঠিক আছে, এখানে ঠিকসময় টাকা-পয়সা দেইনা, এই মাসের শেষে বেতনটা পাইয়া হাইয়া তারপর একবারে বাইড় যামু

এই কথা হওয়ার পর সাথীকে রেখে তারা গ্রামে ফিরে এলো। ২৪শে নভেম্বর (৯ই মহরম), সোমার কাছ থেকে বাবা তাজরীনের অগ্নিকান্ডের কথা জানতে পারে। মোকলেস সঙ্গে সঙ্গে সাথীরে ফোন দেয়, রিং হয়, কিন্তু সাথী ফোন ধরে না। কিছুক্ষন পর ফোন একদম বন্ধ হয়ে গেলো, আর কোন সাড়া-শব্দ নাই। ঘটনার দিন সাথী ফ্যাক্টরীর ৩য় তলায় কাজ করছিল। মেয়ের খোঁজে মোকলেস বড় ভাই চাচাতো ভাইকে নিয়ে সেই রাতে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেয়। ফ্যাক্টরীর আশেপাশে লোকে-লোকারন্ন। অবস্থার ভয়াবহতায় মোকলেসের সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়। এক ভাই মোকলেসের হাত কোচের মধ্যে শক্ত করে ধরে নিশিন্তপুর স্কুল মাঠে নিয়ে গেলো। সারি সারি লাশ শুয়ে আছে। ভাইরা প্রতিটা লাশের মুখের উপর কাপড় সরিয়ে সরিয়ে মোকলেসকে দেখাতে লাগলো, সাথীকে পাওয়া গেলো না। মোকলেসের এক ভাগ্নে সাথীর বাসায় যেয়ে সোমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, সাথী কোন রং এর কাপড় পড়ে কাজে গিয়েছিল। আবার তারা স্কুলের মাঠে যায়। একটা লাশের মুখ পাশ ফিরে ঘোরানো ছিল, ভাগ্নে মুখটা সোজা করতেই সাথীকে চিনতে পারলো। মোকলেস আর নিজেকে সামলাতে পারেনি কোমরে ওরনা স্বাভাবিকভাবেই শরীরের সাথে পেচাঁনো রয়েছে, যেভাবে সাথী সবসময় পড়ে। শরীরে তেমন কোন পোড়ার দাগ নেই, শুধু হাতের আঙ্গুল পায়ের পাতাটা পুড়ে গেছে। বাবা ২৫ তারিখে মেয়েকে গ্রামে নিয়ে আসে, সেখানেই দাফন করা হয়।

পরিবার মনে করে, ’কেই ইচ্ছা করেই আগুন ধরায় দিছে, হুনছি গেটে তালা দেয়া ছিল, কোন ষড়যন্ত্র না থাকলেতো গেটে তালা দেয়া থাকতো না। আগুন ধরার পর যখন শ্রমিকরা চেঁচামেচি করছে, তখনও গালাগালি করছে, তালা খোলে নাই। তালা দেয়া না থাকলে হগোল্যে বাঁচয়া যাইতো।পরিবার এই অন্যায়ের বিচার চাই।

2022 © All Rights Reserved | Designed and Developed by decodelab