মরিয়ম
বয়ানদাতাঃ স্বাধীন (ছেলে), নাসিমা (ননদ), বাবুল (স্বামী), মজিরন (শ্বাশুরী), শেফালী (বড়জা)
তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট মরিয়ম বনওয়ারি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেনি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিল। গ্রামের এক ছেলে বাবুর সাথে প্রেম করে বিয়ে হয়, কিন্তু মরিয়মের পরিবার সেই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি, তাই দুই পরিবারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল অশান্তি। বাবু ভ্যান/ সিএনজি চালাতো, মরিয়ম গৃহিনী ছিল। অভাবের কারনে মৃধাপাড়ার অনেকই তখন ঢাকার গার্মেন্টসে কাজ করতো। ২০১০ সালে দুই বছরের শিশুকে বাসায় রেখে মরিয়ম ও বাবু ঢাকায় চলে আসে, দুজনে আয়-রোজগার করে সংসারের ঊন্নতি করতে চেয়েছিল। অগ্নিকান্ডের সময় স্বামী-স্ত্রী উভয়ই তাজরীনেই কর্মরত ছিল।
আগুন ধরার ২০-২৫ মিনিট আগে ’তাড়াতাড়ি বেতন প্রদানের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাজরীনের মালিক বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ নীচ তলায় ধোঁয়া দেখা গেলো, তিন তলার শ্রমিকদের মধ্যে হট্টগোল শোনা যাচ্ছে, ’আগুন ধরছে, নীচে আগুন ধরছে..’, তারপর মানুষ ’দৌড় পারা শুরু করছে’। কিছুক্ষন পর ফ্যাক্টরীর সব বাতি নিভে গেলো। মরিয়ম ৪র্থ তলায় কাজ করতো, বাবুল ৫ম তলায়। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকরা ফ্যাক্টরী থেকে বের হতে বের হতে চেয়েছিল, কিন্তু সেসময় একজন ম্যানেজার (মাথায় চুল নাই) সিকিউরিটি দিয়ে ৩য় তলার ’কেচি’ গেটে তালা দিয়ে ’অ্যাটকে ফেলাইছে’, ইনচার্জরা শ্রমিকদের বলতে থাকে ”তোমরা কেউ বাইরোও না, তোমরা এভাবে থাকো, একটু সমস্যা হইছে, লাইন অফ করে দিবে, কোন টেনশন নাই, তোমরা দৌড়াদৌড়ি কইরো না”। ৫ম তলাতে যেয়েও সেই ম্যানেজার ’কেচি গেট টেনে লাগাই দিছে আর সবাইকে একই কথা বলে নামতে নিষেধ করতেছে’, কিন্তু কিছু উদ্বিগ্ন শ্রমিক তার কথা কর্নপাত না করে ওই ম্যানেজারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। বিল্ডিয়ের ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম তলার শ্রমিকরা অন্য দিকের বড় সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করে।’ বাবুল ৪ তলায় এসে একবার মরিয়মকে খোঁজার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধোঁয়ায় চোখ পুড়তেছিল। অন্য শ্রমিকরা বাবুলকে টেনে বড় সিঁিড় দিয়ে বিল্ডিয়ের বাইরে নিয়ে আসে ’চল আগে বের হয়’। বাবুলরা নেমে ফ্যাক্টরীর বাইরে চলে আসার ২-৩ মিনিটের মধ্যে ’আগুন ছড়ায় গেলো গা।’ বড় সিড়িতে কোন আগুন ছিল না, ’মহিলাগনের সিঁিড়র ওহানে মোট আগুন, নীচ তলার ফ্লোর দিয়েই তো সিঁিড়, আর ঝুটনের, তহন আগুনের তাপটা পুরো সিঁিড়র পাশে ধইরা গেলো, আর ধূমা, ধূমার কারনে অন্ধকারে কেউ সিঁিড় দিয়া... মানে কোন রাস্তা দিয়া যাবে.. কোনদিকে সিঁিড় বুঝতে পারে নাই, ধূয়ায় একেবারে ইয়ে হয়ে গেলো গা, খালি চোখ পোড়া, আর কিচ্ছু দেহা যাচ্ছে না। তখনও কিছু কিছু লোক পাঁচ, ছয় ও সাততলায় বইসে ছিলো, তার মধ্যে কেউ জানালা দিয়ে.. কেউ টয়লেটে গেছে..। নীচে এসে দেখি, ৩ জন সিকিউরিটি গার্ড গেটের সামনে খাড়ায় রয়ছে, আর ফোন দিতাছে, আর যত স্টাফ আছে, ঐ যে ম্যানেজার (মাথায় চুল নাই) সেও নীচতলায় এসে খাড়ায় রইসে।”
ঔসময় বার বার মরিয়মকে ফোন দিলেও সে ফোন ধরেনি, ভাগ্যের কি ফের, সেদিন মরিয়ম ভুল করে লাঞ্চের সময় বাসায় মোবাইল ফোন ফেলে রেখে এসেছিল। ঐদিন দুপুরে মরিয়ম বাসা থেকে ননদ (নাসিমা) কে ফোন করে ছেলের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল।
এদিক-ওদিক অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও কোথাও মরিয়মের সন্ধান পাওয়া গেলো না, বাবুলের তখন পাগল হওয়ার মত অবস্থা। এভাবে দুদিন পার হয়ে গেলো; অবশেষে ২৬ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের হিম মর্গে মরিয়মের অসার শরীর পাওয়া গেলো। চেহারা চেনা যাচ্ছিল না, পোড়ে নাই, কিন্তু তাপে বোধ হয় সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, মরিয়মের পরনের কাপড়ও পোড়ে নাই। মরিয়ম ও বাবুল ঘটনার ৩-৪ আগে কাপড়টা বানিয়েছিল, আসলে পোশাক দেখেই মরিয়মকে চেনা গেছে, তাছাড়া তার তলপেটে সেলাই এর দাগ ছিল।